ভূমিকা: শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সফল ফ্রিল্যান্সার
ফাহিমুল করিম... মাগুরার এক তরুণ, যিনি তাঁর শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার এক মূর্ত প্রতীক। ডুচেন মাসকুলার ডিসট্রফি - [Duchenne Muscular Dystrophy - DMD] নামক জটিল রোগে আক্রান্ত হলেও তাঁর ইচ্ছাশক্তি ও মেধা তাঁকে বিশ্বের অন্যতম সেরা অনলাইন মার্কেটপ্লেস ফাইভার এবং আপওয়ার্কে সফল করেছে। আসুন, এই অদম্য যোদ্ধার গল্পে ডুব দেওয়া যাক।
জীবনের পথে নানা বাধা আসতে পারে, তবে ইচ্ছাশক্তি আর ধৈর্য থাকলে সেই বাধা জয় করা সম্ভব। মাগুরার বিস্ময় বালক ফাহিমুল করিম সেটাই প্রমাণ করেছেন। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েও তিনি ছিলেন একজন সফল ফ্রিল্যান্সার। চলুন জেনে নিই তাঁর জীবনের গল্প।
শারীরিক অক্ষমতা? নয় জীবনের বাধা!
ফাহিমুল করিম। বয়স মাত্র ২১। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েও যিনি দাঁড়িয়েছেন সাফল্যের মঞ্চে। ডুচেনে মাসকিউলার ডিসথ্রফি নামক বিরল রোগে অল্প বয়সেই পুরো শরীর কার্যত অসাড় হয়ে যায় তাঁর। কিন্তু নিজের মনোবল আর ইচ্ছাশক্তিকে হাতিয়ার বানিয়ে আজ তিনি একজন সফল ফ্রিল্যান্সার। মাগুরার ছোট্ট শহর থেকে উঠে এসে ফাইভার ও আপওয়ার্কের মতো আন্তর্জাতিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস এ নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন ফাহিমুল।
শৈশবের উচ্ছ্বাস থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা
ছোটবেলায় সাইকেল চালানো, ক্রিকেট খেলা আর পড়াশোনায় এগিয়ে থাকা ছেলেটি ২০১২ সালে জেএসসি পরীক্ষার সময় হঠাৎই বিছানাবন্দী হয়ে পড়েন। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, তাঁর পেশিগুলো ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে এবং একসময় পুরো শরীর অচল হয়ে পড়বে। নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া আর সম্ভব হয়নি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ফাহিমুলের স্বাভাবিক জীবন থমকে যায়। অল্প বয়সেই শরীরের পেশি দুর্বল হয়ে পড়ার ফলে ফাহিমের শরীর প্রায় পুরোপুরি অচল হয়ে যায়।
চিকিৎসকেরা জানান, এটি ডুচেন মাসকিউলার ডিসথ্রফি— জেনেটিক রোগ, যার কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই। এই কঠিন বাস্তবতা ফাহিমুলকে বিছানায় বন্দি করে ফেলে। পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মনের জোরে তিনি ঠিকই উঠে দাঁড়ান নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
হাল ছাড়েননি ফাহিমুল: শুরু অনলাইন জগতে পথচলা
এই কঠিন সময়েও থেমে থাকেননি ফাহিমুল। পড়ালেখা বন্ধ হলেও জ্ঞানার্জন থামাননি। তিনি বলেন, "ছোটবেলা থেকেই নতুন কিছু শেখার প্রতি আমার ভীষণ আগ্রহ ছিল।" বিজ্ঞান বই নিজের উদ্যোগে পড়া থেকে শুরু করে বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু অর্থ সঞ্চয় করেন। সেই টাকায় ২০১৪ সালে একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন কিনে ইন্টারনেটে যুক্ত হন। সেখান থেকেই শুরু হয় অনলাইনে আয়ের পথচলা।
ফাইভার থেকে শুরু: প্রথম উপার্জন এবং ফ্রিল্যান্সিং এর সূচনা
২০১৫ সালে ফেসবুকে অনলাইনে আয়-রোজগার অর্থাৎ অনলাইনে ইনকাম এর বিষয়টি জানতে পারেন। শুরুতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তবে থেমে থাকেননি। ২০১৬ সালে অন্যদের সহযোগিতায় একটি ল্যাপটপ কিনে ইউটিউব দেখে নিজে নিজে গ্রাফিক ডিজাইন শিখতে শুরু করেন। ২০১৭ সালে ফাইভার গিগ খুলে প্রথম কাজটি পান মাত্র $5 ডলারে। প্রথম কাজের সফলতায় বায়ার তাঁকে $10 বোনাস দেন।
ফেসবুক গ্রুপ থেকে ওডেস্কের (বর্তমানে আপওয়ার্ক) কথা জানতে পারেন। সেখান থেকেই এইচটিএমএল শেখা শুরু করেন। পরে স্থানীয় এক ব্যক্তির সহায়তায় গ্রাফিক ডিজাইনে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পান। মায়ের জমানো টাকা ও ব্যাংক ঋণে ২০১৬ সালে একটি ল্যাপটপ কেনেন তিনি।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফাইভারে প্রথম গিগ তৈরি করেন ফাহিমুল। অল্প সময়েই প্রথম কাজ পান, আর সেই কাজ শেষ করে বায়ারের প্রশংসা অর্জন করেন। মাত্র $15 আয় দিয়ে শুরু হয় তাঁর ফ্রিল্যান্সিং এ সফলতার ক্যারিয়ার। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
মাসে ৫০ হাজার টাকা আয়, পরিবারের ভরসা ফাহিমুল
ধীরে ধীরে দক্ষতা বাড়িয়ে ফাহিম ফাইভারে লেভেল টু সেলার এবং আপওয়ার্কে টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার হন। গ্রাফিক ডিজাইনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে শুরু করেন। ফাহিমুল প্রতিমাসে গড়ে ৫০ হাজার টাকা আয় করা শুরু করেন। অসাড় শরীর আর সচল মাথা ও দুই আঙুলের ওপর ভর করেই তিনি ফ্রিল্যান্সিং দুনিয়ায় এই সাফল্য অর্জন করেছেন।
তাঁর উপার্জনে পরিবারে ফিরে এসেছে স্বচ্ছলতা। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে মাগুরা শহরে জমি কিনে একটি বাড়ি করেছেন তিনি। বোনের লেখাপড়ার খরচও আসে তাঁর উপার্জন থেকে।
ফাহিমুলের শরীর পুরোপুরি অচল, শুধু মাথা এবং ডান হাতের দুটি আঙুল কিছুটা সচল। এই সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করেই তিনি আপওয়ার্কে প্রতি ঘণ্টায় ৮ ডলার রেটে কাজ করেন। ফাইভারে তিনি লেভেল টু সেলার এবং আপওয়ার্কে টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার ব্যাজধারী।
স্টিফেন হকিংয়ের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা
ফাহিমুল নিজের সংগ্রামে বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংয়ের জীবন থেকে প্রেরণা পেয়েছেন। তিনি বলেন, "আমি কখনো নিজেকে দুর্বল ভাবিনি। স্টিফেন হকিং প্রমাণ করেছেন, শারীরিক সীমাবদ্ধতা মানুষকে থামিয়ে রাখতে পারে না।"
আগামী দিনের পরিকল্পনা ও তরুণদের জন্য পরামর্শ
ফাহিমুল জানেন, শারীরিক অবস্থা ক্রমেই জটিল হতে পারে। তাই তিনি ভবিষ্যতে একটি ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা করছেন, যেখানে আরও মানুষের কর্মসংস্থান হবে। নতুন কিছু শেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ প্রতিনিয়ত তাঁকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
তরুণ ফ্রিল্যান্সারদের উদ্দেশে ফাহিমুল বলেন, "ধৈর্য এবং অধ্যবসায় ছাড়া ফ্রিল্যান্সিংয়ে সাফল্য সম্ভব নয়। ইংরেজি শেখা, সময়ের সঠিক ব্যবহার এবং বায়ারদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"
জীবন কখনো কখনো সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। মাগুরার বিস্ময় বালক ফাহিমুল করিম এর জীবন এমনই এক গল্প, যেখানে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কখনো তাঁর অগ্রগতির পথ রোধ করতে পারেনি। একমাত্র মাথা ও ডান হাতের দুটি আঙুল সচল রেখে যিনি ফ্রিল্যান্সিং জগতে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। তাঁর জীবনের এই অনুপ্রেরণামূলক যাত্রা আমাদের শেখায়, ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোনো বাধাই বাধা নয়।
শেষ বিদায়:- কিন্তু অনুপ্রেরণা রয়ে গেল
২০২০ সালের ১২ নভেম্বর, মাত্র ২১ বছর বয়সে, ফাহিমুল করিম আমাদের ছেড়ে চলে যান। ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁর জীবনাবসান হয়। তবে তাঁর জীবনের গল্প হাজারো মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে।
Freelancing Geek থেকে আরো পড়ুন...
হারিয়ে যাওয়া সফল ফ্রিল্যান্সার ফাহিমুল করিম - আমাদের শেষকথা
ফাহিমুল করিম শুধু একজন সফল ফ্রিল্যান্সার-ই নন, তিনি এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর সংগ্রামী জীবন গল্প আমাদের শেখায়, ইচ্ছাশক্তি আর মনোবল দিয়ে জীবনের যেকোনো বাধা জয় করা সম্ভব। আপনার পথচলা আমাদের জন্য আলোকিত করে ফাহিমুল!